মীর আশরাফুজ্জামান : ১৮৬১ সালের ৭ই মে, বাংলা ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ- কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী, পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ- ছোটোবেলা থেকেই কবি প্রতিভার পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের, তাই মাত্র ৭ বৎসর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা রচনা করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য উজ্জ্বল অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সবচাইতে বড়ো পরিচয়- তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, চিত্রকলা- সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবি ঠাকুর বিচরণ করেন নি। মানুষের এমন কোনো মানবিক অনুভূতি নেই, যা রবীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়া যায়না- প্রেম, বিরহ, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালোবাসা সব জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ যেন অমলিন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে, বিশ্বের মানুষের কাছে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই যুগের পর যুগ বাঙালির চিন্তায় ও মননে নিবিড়ভাবে মিশে আছেন বিশ্বকবি, গুরুদেব। এজন্য রবীন্দ্রনাথের প্রতি চিরদিন বাঙালি জাতির ঋণ স্বীকার করা উচিত। একজীবনে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, দর্শন, মানবিক প্রেম, সৃষ্টিশীলতা- যুগ যুগ ধরেই বাঙালি জাতিকে করেছে মহিমান্বিত।
আজ রবীন্দ্রনাথ না থাকলে বাংলা সাহিত্য যেমন
অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকতো, তেমনি মানুষ সাহিত্য পাঠ থেকেও বঞ্চিতপ্রাপ্ত হতো। রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একজন কবিই ছিলেন না, একজন মহান মানবতাবাদী দার্শনিক; তিনিই আমাদেরকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন যে- সাহিত্য, ইতিহাস, সংষ্কৃতি মানবতাবাদেরই এক অভিন্ন প্রতীক। সাহিত্য, সংষ্কৃতি যে মানুষের জীবন চলারই এক ওতঃপ্রোত অংশ, তা রবীন্দ্রনাথই আমাদেরকে অনুধাবন করিয়েছেন।
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর Gitanjali ( Song Offerings) কাব্যগ্রন্থের জন্য এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরষ্কার অর্জনে ভূষিত হোন। বিশ্বের একমাত্র কবি রবীন্দ্রনাথ- যিনি রচনা করেছেন দুটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত- বাংলাদেশ এবং ভারত। তিনি বাংলাদেশে প্রথম কলের লাঙল নিয়ে আসেন, শুধু তাই নয়, তিনি এদেশে সর্বপ্রথম মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থার প্রচলন করেন অর্থাৎ অত্যাচারী জমিদারদের হাত থেকে গরীব-দুস্থ-অসহায় প্রজাদেরকে অল্প সুদে ঋণ নেবার ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরষ্কারের ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা নওগাঁর পতিসর কৃষিব্যাংকে রাখেন গরিব প্রজাদেরকে সেবা করবার জন্য- তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রজাদরদী জমিদার; প্রজাদের কিসে কল্যাণ হয়- আজীবন রবীন্দ্রনাথ এটাই চিন্তা করে গিয়েছেন। তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তোলেন, শুধু তাই নয়- আমরা অনেকেই জানি না যে- রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার- তিনি শিলাইদহ অঞ্চলে গরীব-দুখী মানুষদেরকে বিনা অর্থে চিকিৎসা করতেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সমবায় প্রথার প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ। সমবায়ের মাধ্যমে মানুষ একত্রিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মপ্রচেষ্টাকে সফলান্বিত করার জন্য তরুণ সমাজকে একতাবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন বিশ্বকবি, গুরুদেব। সমাজের সকল অবহেলিত মানুষ যেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তারা যেন বিশ্বের সকল প্রতিষ্ঠিত মানুষদের সাথে ঐক্যবদ্ধসূত্রে চলতে পারে- আজীবন রবীন্দ্রনাথ এই চিন্তা করেছেন। তিনি গ্রামে শালিসী ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, মন্ডলীপ্রথার প্রবর্তন করেন- পল্লীউন্নয়নের জন্য তিনি সকলকে এক হওয়ার কথা বলেছেন এবং সকলকে সুশিক্ষা অর্জন করার কথা বলেছেন।
সমগ্র জীবন রবীন্দ্রনাথ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে এসেছেন- তাই ১৯১৯ সালে ভারতের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ব্রিটিশ সরকারের দেয়া রাজকীয় খেতাব ” Knighthood” উপাধী। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কতজন মানুষ জন্মগ্রহণ করতে পেরেছেন যে- অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান নির্বিঘ্নে বিসর্জন করতে পেরেছেন? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই জন্ম থেকে জন্মান্তরেই মানুষকে মনে করিয়ে দেবে যে- মানবতাবোধই হচ্ছে মানুষের জীবনের পরম পাথেয়।
সংঘর্ষপ্রবণ বাস্তবতার আলোকে মানুষের প্রতিমুহূর্তের আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ, ৫০ এর দশকের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, স্বাধিকার আন্দোলন- ভারতীয় জাতীয় মুক্তির আন্দোলন; সবজায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালির একান্ত অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা সেসময় যুদ্ধোত্তর মুক্তিকামী মানুষদেরকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো- রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গান গেয়ে বাংলার সূর্য সন্তানেরা নির্ভীক চিত্তে যুদ্ধে নেমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।
রবীন্দ্রনাথ আজীবন বাঙালি জাতির গর্ব, তিনি দেশ ও জাতির স্বপ্নোজ্জ্বল ভবিষ্যত। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১৬০ বৎসর পার হয়ে গিয়েছে, তবুও তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাঙালির কাছে এতটুকুও মলিন হয়ে যায়নি বরং যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষ রবীন্দ্র চর্চা করছে এবং রবীন্দ্রনাথের আদর্শে নিজেকে তৈরি করছে। আজ আমরা যে অসাম্প্রদায়িকতার বাংলাদেশ গড়েছি, এই অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা রবি ঠাকুরের কাছ থেকে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, কিভাবে মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসতে হয়, তিনি শিখিয়েছেন- সকল বর্ণের, সকল গোত্রের, সকল ধর্মের এবং সকল শ্রেণীপেশার মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। যদি প্রশ্ন ওঠে যে, এতবৎসর পরেও রবীন্দ্রনাথ কেন প্রাসঙ্গিক? তাহলে বলতে হবে যে- যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে এবং বাংলাভাষা-ভাষী মানুষ থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে থাকবেন। সুখে-দুখে-বিপদে-আপদে সবসময়ই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা, তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার আমাদের ফিরে যেতে হবে।
আজ রবীন্দ্রনাথের ১৬০ তম জন্মবার্ষিকী, এই দিনে অগণিত ভক্তরা তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন- আমরা শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনই নয়, মৃত্যুদিনই নয়; রবীন্দ্র চর্চা করবো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চা যতটুকু হচ্ছে, এর চাইতেও রবীন্দ্র চর্চাকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন তিনি যেন দেশে মুক্তমন-মানসিকতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চর্চার জন্য একটি রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।
কারণ, রবীন্দ্রনাথকে শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখলে চলবেনা, রবীন্দ্র চেতনা পৌঁছাতে হবে সকল শ্রেণীপেশার মানুষের কাছে- রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে- রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টিকে বিশ্লেষণ করতে হবে, এজন্য রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করলে সকল মানুষেরই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা আগ্রহ জন্মাবে এবং তারা যথার্থভাবে রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ণ করতে পারবে। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে অশেষ প্রাপ্য সম্মান- তাকে জোরালো ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাঁর জন্মদিনকে অবশ্যই সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা উচিত বাংলাদেশ সরকারের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এটা আমাদের পরম নিবেদন।
খামখেয়ালী সভা নামে একটি উল্লেখযোগ্য সংগঠন- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে ২০১৪ সাল থেকে উক্ত সংগঠন চালু করেছেন- এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরে ১ বৎসর মেয়াদী রবীন্দ্র অধ্যয়নসভা নামে একটি কোর্স রয়েছে, আমিও ২০১৯ সালে সফলভাবে সেই কোর্সটি করেছি। রবীন্দ্রনাথের বাইরেও তারা বাংলাসাহিত্য অধ্যয়নসভা, বিশ্বসাহিত্য অধ্যয়নসভা নামে কিছু কোর্স চালু করেছে- তবে তাদের সংগঠনের কর্মকান্ডের মূল ভিত্তিই রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে।
এছাড়া বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সাংষ্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটেও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষাগ্রহণ করানো হয়- যার প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য সনজীদা খাতুন ম্যাম; রবীন্দ্র সঙ্গীতে যার অবদান অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোট ৪টি স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন রয়েছে।
১। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি।
২। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি।
৩। নওগাঁর পতিসর কালিগ্রামের কাছারিবাড়ি।
৪। খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শশুড়বাড়ি অর্থাৎ তাঁর সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবী রায় চৌধুরীর বাড়ি।
বাংলাদেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে মোট ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
১। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় শাহজাদপুর।
২। রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।
৩। রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জ।
বাংলাদেশে মোট ৫ জন ব্যক্তি রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য হিসেবে পরিচিত।
১। সৈয়দ আকরম হোসেন।
২। ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ।
৩। সনজীদা খাতুন।
৪। আনিসুজ্জামান।
৫। আহমদ রফিক।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে—
১। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
২। অদিতি মহসিন।
৩। অণিমা রায়।
৪। লিলি ইসলাম।
৫। তপন মাহমুদ।
৬। সনজীদা খাতুন।
৭। সাদী মুহম্মদ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র রচনাবলী মোট ২৫ খন্ডে বিভগ্ত, যা শাহবাগ পাঠক সমাবেশ, বাংলাবাজার ঐতিহ্য প্রকাশনীতে পাওয়া যায়, তাছাড়া কলকাতা বিশ্বভারতীতেও তাঁর সমগ্র রচনাবলী পাওয়া যায়।
আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পড়বো, তাঁর গান শুনবো এবং রবীন্দ্র চেতনা নিজ বক্ষে ধারণ করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী আত্মপ্রত্যয়ী সুশীল সমাজ গঠন করবো- এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
সম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়েছে অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প- এসবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্র চর্চাই পারে মানুষকে মুক্ত, শাণিত, সত্যনির্ভর এবং যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে।
রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের, চিরকালের, চিরপথের হয়েই বেঁচে থাকবেন বাঙালি জাতির বাংলাভাষাভাষী সকল মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়। রবীন্দ্রনাথকে আজীবনই মনের মধ্যে গেঁথে রাখতে হবে, যতদিন মানুষ কথা বলবে বাংলা ভাষায়, যতদিন বাঙালিত্বের চেতনাবোধ মানুষের মধ্যে সমানভাবে সঞ্চারিত হবে। রবীন্দ্রনাথ- গুরুদেব তাই তো সেকালের হয়েও তিনি একালের সর্বকালের বিশ্ববিজয়ী মহামানব- যে মানুষকে কোনো দেশের, কোনো ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা যায়নি- এজন্যই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হয়েও তিনি বিশ্বের কবি- বিশ্বমানবতাবোধের মহান কারিগর। সমগ্র পৃথিবীর মানুষকেই রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছিলেন, জীবনকে দেখেছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে- মিশেছেন গ্রামের সরল বঞ্চিত অসহায় মানুষদের সঙ্গে।
আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়, প্রতিটি রক্ত কণিকার সাথে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব ভালোবাসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত- এজন্যই আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা চিরদিন যাবৎ প্রবাহমান, তাই জীবনে যত প্রতিকূলকৃত দুরাবস্থাই আসুক না কেনো- রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের, চিরকালের হয়েই মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছেন।
শুধুমাত্র রোমান্টিকতাতেই রবি ঠাকুর নন, বাস্তব জীবনকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন বিশ্বকবি, গুরুদেব। মানুষের জীবনটা যে কতটা শোচনীয় নিদারুণ কঠিন হতে পারে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন রবীন্দ্রনাথ; তাঁর জীবদ্দশায় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের জীবনাবসান তাকে মেনে নিতে হয়েছে- রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবী, সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবী, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ, কন্যা রেণুকা দেবী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান- এটা যে কতটা কষ্টের হতে পারে, কতটা মর্মান্তিক বেদনার হতে পারে, তা রবীন্দ্রনাথকে সেসময় অনুধাবন করতে হয়েছে। তবুও রবীন্দ্রনাথ জীবনে বিচলিত হননি; সকল বাধা-বিঘ্ন প্রতিকূলকৃত অবস্থাকে পাড়ি দিয়েও মানুষকে যে জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয় তা রবীন্দ্রনাথ ঠিকই উপলব্ধি করেছেন- এজন্যই তিনি লিখেছিলেন যে- “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ- তবুও অনন্ত জাগে।” রবীন্দ্রনাথ কাঁদতে পারেন নি ঠিকই, কেঁদেছে তাঁর অন্তরাত্মা; তাঁর বুকের মধ্যে সীমাহীন কান্নার স্রোত প্রবাহিত হয়ে গেলেও তিনি মৃদু হাসির মাধ্যমে তা প্রকাশ করে নিজের মনকে সান্ত্বনা জ্ঞাপন করেছেন- জীবনে সবাইও যদি চলে যায়, কেউই যদি অবলম্বন হিসেবে না থাকে; তাহলে সত্য সুন্দর মানবতার পক্ষে একলাই চলাচল করতে হবে- এজন্যই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে- “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।” কোনো মানুষের জন্যই কোনো মানুষের প্রাত্যহিক চলমানিত জীবনবোধ কখনো থেমে থাকে না, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষই একলা এসেছে, প্রত্যেকটি মানুষকে একলাই পৃথিবী ছেঁড়ে চলে যেতে হবে- এই নির্মম সত্যকৃত উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে করেছেন। সীমাহীন বেদনা এবং প্রবল কষ্টের মধ্যে থেকেও রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিবেদিত করেছেন মানবতার কল্যাণে, মানুষকে বাদ দিয়ে- মনুষ্যত্বকে উপেক্ষা করে কোনো মানুষ যে পরিপূর্ণতার দিকে ধাবিত হতে পারে না- তা রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে শিখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে শিক্ষা দেয় মনুষ্যত্ব তথা মানবিকতাবোধের, মানবিক প্রেমের, আদর্শ সুশীল আত্মপ্রত্যয়ী সমাজ গঠনের, আত্মশক্তিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবনসংগ্রামে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্য, সুন্দর এবং মানবতার পূজারী- জীবনে কেউই যদি না আসে, সবাইও যদি চলে যায়, তারপরেও তিনি মানুষকে একলা চলবার আহবান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট আসবেই তাতে বিচলিত হলে চলবেনা বরং সাহসিকতার সাথে সেই বিপদকে মোকাবিলা করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাঁর সব সৃষ্টিই কালজয়ী, কিন্তুু তারপরো কিছু সৃষ্টি যেনো চিরদিনই অমলিন এবং মানুষের হৃদয়ের অন্তরালে গভীরভাবে প্রথিত হয়ে যায়; আর তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গান।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন- “আমার কবিতা, গল্প, নাটকের ভাগ্যে ভবিষ্যতের দরবারে যাই জুটুক না কেনো- আমার গান বাঙালি জাতিকে নিতেই হবে। আমার গান গাইতেই হবে সকলকে- বাংলার ঘরে ঘরে, প্রান্তরে, নদীতীরে”।
তাইতো, আজীবনই রবীন্দ্রনাথের গান মানুষ গেয়ে থাকে। সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে, মানুষের সকল মানবিক অনুভূতিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আজ পর্যন্তও যেন বাঙালি জাতিকে আশার আলো দেখায়। রবীন্দ্রনাথের গানগুলোর মধ্যে একদিকে রয়েছে যেমন অনাবিল আনন্দ চিত্তচাঞ্চল্যকরতা রোমাঞ্চকরতা, তেমনি রয়েছে সীমাহীন বেদনা, বিরহ এবং কষ্টাঘাত- এজন্য একদিকে রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে আনন্দে যেমন মন নেচে ওঠে, তেমনি আরেকদিকে তাঁর গান শুনলে কষ্টাঘাতে অশ্রু বিসর্জন করতে ইচ্ছা করে। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন পর্যায়ের গানই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে প্রেম, আনন্দ, বিরহ, ঈশ্বরচেতনাবোধ, স্বদেশপ্রেম স্বদেশানুরাগ দেশাত্মবোধ, অধ্যাত্মবোধ আধ্যাত্মিকতা, প্রকৃতি প্রেম, মানবপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, বিশ্বমানবতাবোধ, সৌন্দর্যবোধের চেতনাগত মিলনাত্মিক দিক- সবকিছুই রবীন্দ্রনাথের গানকে করেছে মহিমান্বিত। তাই যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে মানুষের ভালোবাসা কমে যায়নি, বরং রবীন্দ্রনাথের গানকে জীবনের পরম পাথেয় এবং তা মানবজীবনের প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ কণার রক্ত-চলাচলের শিরা-উপশিরার প্রাণস্পন্দন হিসেবে মানুষ বেছে নিয়েছে।
যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে অনভ্যস্ত, তারা রবীন্দ্রনাথের গান শুনুন, রবীন্দ্রনাথের গানকে মানবিকতার দিকদর্শন হিসেবে বিবেচনা করে বিশ্লেষিত মানসিকতা জ্ঞাপন করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ মর্মার্থতা উপলব্ধি করুন এবং রবীন্দ্রনাথের গানকে জীবনচলার পরমাশ্রয় হিসেবে মনে করে আজীবন রবীন্দ্রনাথের গান শুনুন, রবীন্দ্রনাথের গানের বই পড়ুন।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমাদের প্রেম চেতনার পরিচয়টিও বিশেষভাবে ধারণ করতে হবে- বিশেষ করে, তাঁর প্রেম পর্যায়ের অনেক গান, কবিতা আমাদেরকে পড়তে হবে। এই প্রেম যে শুধু দৈহিক সৌন্দর্যে বিকশিত, তা নয়- প্রেমের মধ্যে বিশ্বাস, সত্যাসত্য, পারষ্পরিক ঐক্যবদ্ধ মিলন থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা, গান এবং প্রবন্ধ পড়লে আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মূল দিকটি সম্পর্কে অবগত হতে পারি- সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একজন মহান প্রেমিকও বটে- রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে বিভিন্ন নারীদের প্রেমে পড়েছিলেন- তাঁর এই প্রেম কোনো দৈহিক মিলনবদ্ধিত নয়, বরং আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনবন্ধনে যে সততাসিদ্ধ প্রেম সৃষ্ট হয়- তা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিখতে হবে- এজন্য রবীন্দ্রনাথের প্রেমকে শুধু প্রেম হিসেবে আখ্যা না দিয়ে মানবিক প্রেম হিসেবেই আখ্যায়িত করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ পুরাতন, জীর্ণ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ কূপমন্ডুকতাকে পরিহার করে নূতনকে আহবান করেছেন, নূতনকে জাগতে বলেছেন, প্রতিকূলতাকে নিজ শক্তি দ্বারা জয় করবার কথা বলেছেন- এজন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষদিকে রচিত প্রবন্ধ “সভ্যতার সংকটের” শেষের দিকের অংশে লিখেছিলেন যে- “মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে, আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।”
আমরাও বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের এই দার্শনিক চেতনা সমৃদ্ধ ভাবনার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে পরম নিবেদন জানাবো যে–
” হে আমাদের প্রভু- আপনি সমগ্র বিশ্বের মানুষদেরকে মহামারী করোনার দুর্বিষহ বিপাক থেকে রক্ষা করুন, মহাপ্রলয়টাকে কাটিয়ে উঠবার মতো শক্তি আমাদেরকে দিন, মানুষ যেনো তাদের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধাকে অতিক্রম করে সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে পারে- করোনাতে যেন আর একটি প্রাণও নিঃশেষিত হয়ে না যায়, অতিসত্ত্বর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়ে মহামারী করোনাকে যেন সমূলে উৎপাটন করে ফেলতে পারে সমগ্র পৃথিবী থেকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের পরম নিবেদন এটা আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনের প্রথম সকালে”।
১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর নিজ ঠাকুরবাড়িতে মহাপ্রয়াণ ঘটে রবীন্দ্রনাথের, তবে তাঁর এই চলে যাওয়া দেহান্তর মাত্র- তিনি আমাদের মাঝে ছিল, আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল ধরে।
আজ ২৫শে বৈশাখ বিশ্বকবি, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার অন্তরের অশেষ শ্রদ্ধা এবং সীমাহীন ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে, আমার সকল বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে রবীন্দ্র জয়ন্তীর প্রীতি ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।
পরিশেষে রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে আমার আলোচনা শেষ করছি।
হে নূতন-
দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
তোমার প্রকাশ হোক-
কুহেলিকা করি উদঘাটন সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষভেদি আপনারে করো উন্মোচন-
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়, ব্যক্ত হোক-
তোমা-মাঝে অসীমের চিরবিষ্ময়।
উদয়দিগন্তে শঙ্খবাজে মোর চিত্তমাঝে-
চিরনূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ।
———– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লেখক পরিচিতি : মীর আশরাফুজ্জামান, বাংলাদেশের একজন তরুন রবীন্দ্র গবেষক। সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের ওপর অনেক লেখা রয়েছে ।