উত্তরে হিম তখনো খুব একটা পড়তে শুরু করেনি। বাঁশবনে পাতা ঝরা দিন শুরু হয়নি। সোনালি বিষণ্নতা মেখে আকাশে ওড়ে শঙ্খচিল। কেটে রাখা ধানের খেতের ওপর সন্ধ্যার মুখে ঝুলে থাকা ফিতের মতো কুয়াশার রেখা। পুরো মাঠ, বিল ভরে থাকে নতুন ধানের গন্ধে। এ গন্ধ নিয়ে আসে নতুন পরব, নবান্ন।
দিনক্ষণ খুব একটা নির্দিষ্ট থাকে না। শুধু পঞ্জিকা দেখে একটা শুভ দিনে সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো। এ উৎসবে কেউ অনাহূত নয়, রবাহূত। অবশ্য নিমন্ত্রণ জানানোর আগে ঘটে যায় আরও কিছু ঘটনা। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনে সে ঘটনা নেহাত সাদাসিধে নয়।
কার্তিকের পোয়াতি ধান পেকে ওঠে অঘ্রানে। প্রকৃতিতে তখন হরেক রং—সবুজ হলুদ হয়ে সোনালি। পেকে ওঠা ধানের দানায় তখন শুভ্র চাল। কৃষকের উঠোনময় ছড়িয়ে থাকে সে ধানের দানা। ব্যস্ততা বাড়ে কিষানির। গোলাঘরে বছরের মতো ঝাড়পোঁছ হয়। মাড়াই করা ধান ওঠে গোলায়। এরপর ব্যস্ততা কমে গেলে সে ধান সেদ্ধ হয়ে তৈরি হয় চাল। নতুন চাল। তত দিনে বাড়ির ভিটেয় বড় হতে থাকে শীতের সবজি। এক শুভ দিনে ডাক পরে আত্মীয়স্বজনের।
নবান্ন অর্থ নতুন খাবার। নব অন্ন। অন্ন অর্থ খাবার, খাদ্যদ্রব্য, আহার্য দ্রব্য; শুধু ভাত নয়। যেহেতু আমাদের অঞ্চলে ভাত প্রধান খাবার এবং ধান প্রধান শস্য, তাই নবান্ন মানে বোঝানো হয় নতুন ধান থেকে ছেঁটে নেওয়া নতুন চালে রান্না করা নতুন ভাত। এ কারণে চলতি অর্থে অন্ন মানে ভাত। তবে একমাত্র ভাতই অন্ন নয়।
নবান্ন কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব। আবার এটাকে ঠিক উৎসবও বলা চলে না। বলা চলে রিচুয়াল বা অবশ্য পালনীয় আচার বা প্রথা। জীবন যখন কৃষির সঙ্গে যুক্ত, তখন তার আচার-প্রথা হবে শস্যকেন্দ্রিক, এটাই স্বাভাবিক। শস্য বোনা থেকে শুরু করে তোলা এবং সংরক্ষণ করা—সবকিছুকে ঘিরেই তাই পৃথিবীর সব কৃষিকেন্দ্রিক জনপদে দেখা যায় উৎসব আর আচার পালনের ঘটা। ইউরোপ, এশিয়ার প্রায় সব দেশে খুঁজলে নতুন ফসল তোলার উৎসব পাওয়া যায়।
ফ্রান্সের প্রোভান্স শহরে প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষ রোববার পালিত হয় নতুন ফসল তোলার উৎসব। চীনে পালিত হয় মিড অটাম ফেস্ট। ভারতের আসামে ভোগালি বিহু বা মাঘ বিহু, পাঞ্জাবে লহরি, ওডিশায় নুয়াখাই, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আরও বিভিন্ন নামে নতুন শস্য তোলার বিভিন্ন উৎসব হয়। দেবী শ্রী উৎসব নামে শস্য তোলার উৎসব হয়
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, মিয়ানমারের ফসল তোলা উৎসবের নাম হতামানে পিউ। বিভিন্ন সংস্কৃতির এসব ফসল তোলার উৎসবের বিভিন্ন নাম হলেও একটা জায়গায় সবার মিল আছে। আর সেটা হলো প্রতিটি উৎসবের মূল আকর্ষণ খাবারদাবার।
শুধু যে বাঙালিরাই খাদ্যবিলাসী, তেমনটা বলা যাবে না। নতুন ফসল তোলার উৎসব পৃথিবীর সব সংস্কৃতির মানুষ নতুন শস্যে তৈরি খাবার দিয়েই উদ্যাপন করে থাকে। চীনের মিড অটাম ফেস্টের প্রধান আকর্ষণ মুন কেক। পদ্ম ফুলের বীজসহ নানা ধরনের বীজ দিয়ে তৈরি এই কেক হলো পারিবারিক মিলনের প্রতীক। মিয়ানমারের হাতামে পিউ উৎসবে রান্না করা হয় হাতামে। ভারতের সব প্রদেশের নতুন শস্য তোলার উৎসবে রান্না করা হয় হরেক রকম খাবার। আমাদের দেশেও নতুন ফসলে রান্না হয় খাবার বা অন্ন। আর সে জন্যই আমরা বলি নবান্ন।